কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল
- সনৎকুমার নস্কর
মধ্যযুগের প্রায় প্রান্তিক কবি কৃষ্ণরাম দাস। আবির্ভাব সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। মঙ্গলকাব্য ধারায় সংখ্যার বিচারে তিনিই প্রথম। প্রতিভার বিচারে মধ্যমেধা। প্রস্তুত গ্রন্থে তার প্রথম রচনা ‘কালিকামঙ্গল’ উপস্থাপিত, যার কাহিনি বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়কথায় সুরভিত ও সাধারণ্যে সুবিদিত। এ গল্প ভারতচন্দ্রের লেখনী-নৈপুণ্যে অনেকদিন থেকেই মুখরোচক। কৃষ্ণরামের আগেও অনেকে লিখেছেন এ উপাখ্যান। কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারে তিনিই ভারত-পূর্ববর্তী সমস্ত কালিকামঙ্গল লিখিয়েদের মধ্যমণি। তিনি মুল কাহিনির সঙ্গে সুকৌশলে বুনে দিয়েছেন এমন দুটি কাহিনি যারা উৎসের বিচারে কিংবদন্তিধর্মী ও পৌরাণিক। রাজা বিক্রমাদিত্য কিংবদন্তির জবরদস্ত নায়ক। তার যোগ্য নায়িকা ভোজরাজ-কন্যা ভানুমতী। তিনি বিবাহ করবার কালে ভোজরাজের দুই সাকরেদ কুঁজা ও কুঁজির দ্বারা ভেল্কিবাজিতে কীভাবে নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন, কৃষ্ণরাম সেই গল্প রসিয়ে বলেছেন। আর দ্বিতীয় গল্পের উৎস হরিবংশ। দৈত্যরাজ বজ্রনাভ-কন্যা প্রভাবতীর সঙ্গে কৃষ্ণপুত্র প্রশ্ন কীভাবে গোপন প্রণয় সম্বন্ধ স্থাপন করে বিবাহ করলেন ও পরে বজ্ৰনাভকে হত্যা করলেন, পুরাণানুগ সে কাহিনিকে বিবৃত করেছেন কৃষ্ণরাম। গল্পদুটি মিলেছে আড়াইশো বছরের পুরোনো কীটদষ্ট ও জরাজীর্ণ এক হস্তলিখিত পুথিতে। তা থেকে পাঠোদ্ধার করে আখ্যানপ্রিয় পাঠকের মনোরঞ্জন ও বিদ্যাযানী গবেষকের অনুসন্ধিৎসার উদ্দেশ্যে এখানে দুই মলাটের মধ্যে তুলে ধরা হল। প্রাচীন পুথির সম্পাদনা আজ বিরল ঘটনা। আরও বিরল আনকোরা কোনো কাহিনিকে পাঠক সমক্ষে হাজির করা। নিমতার অধিবাসী কৃষ্ণরাম দাস সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কবি। তাঁর লেখা ‘কালিকামঙ্গল’-এ খুঁজে পাওয়া গেছে এমন দুটি অভিনব কাহিনি, যাদের সন্ধান আজও কেউ পাননি। উপাখ্যান দুটি হল : বিক্রমাদিত্য-ভানুমতী পরিণয়োপাখ্যান ও প্রদ্যুম্ন-প্রভাবতী প্রণয়োপাখ্যান। গল্পপ্রিয় পাঠক ও বিদ্যাযানী গবেষক মহলে ঝড় তুলতে পারে আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় আগে লিপিকৃত কীটদষ্ট বিরলদৃষ্ট এক ও অদ্বিতীয় সেই পুথি। তাকে সম্পাদনা করে সর্বসমক্ষে হাজির করলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সনৎকুমার নস্কর।
জন্ম : ১৯৬৪-র জানুয়ারিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মণ্ড হারবার মহকুমার এক গণ্ডগ্রাম কাদিপুকুরে। গ্রাম ও মফস্বলের স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন। গবেষণার বিষয় : মুঘল যুগের বাংলা সাহিত্য। কর্মজীবন শুরু হয় সরকারি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে। দার্জিলিং ও হলদিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ে কাজ করার পর যথাক্রমে কল্যাণী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা।
এঁর মৌলিক ও সম্পাদিত দু'ধরনের বই প্রকাশ পাচ্ছে সেই ১৯৯৪ সাল থেকে। প্রথমোক্ত শ্রেণির মধ্যে বিশিষ্ট গ্রন্থগুলি হল : ‘প্রসঙ্গ : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘সাহিত্য-প্রবন্ধ : সেকালে-একালে’, ‘সাহিত্য-বীক্ষণ : উৎস থেকে মোহনায়’, ‘ত্রিস্রোতা : অতীত সাম্প্রত লোকায়ত’, ‘প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্য : পরিপ্রশ্ন ও পুনর্বিবেচনা’, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য : নানা কথা’। সম্পাদিত বইয়ের সম্ভারে ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’, ‘কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, ‘সোমেন চন্দের গল্প : নিজস্ব পাঠের আয়নায়’, ‘একালের বাংলা কবিতা : অনুভবের নিজস্ব ভাষ্যে’, ‘অরণি : গল্প পঞ্চাশৎ' প্রভৃতি গ্রন্থগুলি ইতিমধ্যে অনেক বিদ্যার্থী ও সাধারণ পাঠকের হাত-ফেরতা।
অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হল ‘রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় : দ্বিশত বর্ষের আলোয়’। কাজ চলছে আরো দু'তিনটি বইয়ের।